ভাগ্য বদলাতে দক্ষিণ কোরিয়া
মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় বাড়ি নুরুল হকের। বাবা দরজির কাজ করতেন। তিন ভাই, তিন বোন। সংসারে চরম অনটন। পরিবারের বড় ছেলে নুরুল হক সিদ্ধান্ত নিলেন বিদেশে যাবেন। ফোনের ওপাশ থেকে নুরুল হক বলেন, ‘সময়টা ২০০৪ সাল। আশপাশের গ্রামের অনেকেই তখন দক্ষিণ কোরিয়া যাচ্ছে। আমিও ঠিক করলাম কোরিয়া যাব। পরিবারও রাজি হলো। ধারদেনা করে সাড়ে সাত লাখ টাকা জোগাড় করলাম। ঢাকার এক দালালকে টাকা দিলাম যে বিদেশে লোক পাঠায়। ভিসা হলো, একদিন প্লেনের টিকিটও হলো। সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম নতুন স্বপ্নকে সাথে নিয়ে।’
১৪ বছরের কিশোর নুরুল হক তখনো জানে না সামনে তার জন্য কী সব দিন অপেক্ষা করছে!
কঠোর পরিশ্রমের জীবন
দক্ষিণ কোরিয়ার নামইয়াংজু শহরে গিয়ে পৌঁছালেন নুরুল হক। মুন্সিগঞ্জে তাঁর পরিচিত কিছু লোকও আছেন এই শহরে। কাজ পাওয়া গেল একটি প্লাস্টিকের কারখানায়। তবে তিনি কোরিয়া এসেই জানতে পারলেন, তাঁকে টুরিস্ট ভিসায় পাঠানো হয়েছে। তিন মাস পরেই অবৈধ হয়ে যাবেন। ধরা পড়লেই সমস্যা।
নুরুল হক আবারও বলতে শুরু করলেন, ‘প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করি। সন্ধ্যা থেকে সকাল। সব সময় লুকিয়ে কাজ করতে হবে। অমানুষিক পরিশ্রম। ভাষা জানি না। কাজও ভালো জানি না। মালিক বকে। খুব যন্ত্রণা। তবু বাবা-মা, ভাইবোন আর ঋণের কথা ভেবে পিছনে ফেরার উপায় নাই।’
কাজ করে চলেন নুরুল হক। মাসে ৪৫ হাজার টাকা আয়। নিজে কোনোমতে কষ্ট করে বাড়িতে প্রতি মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা পাঠাতে লাগলেন। প্রায় এক বছর চলল এভাবে। এরপর—নুরুলের ভাষায়, ‘পরপর দুই মাসের বেতন দিতে পারল না মালিক। বাধ্য হয়ে কাজ ছেড়ে দিলাম। কারণ, বেতন না পেলে চলব কীভাবে?’
এরপর শুরু হলো রোজকার শ্রমিক হিসেবে কাঠের আসবাবের এক দোকানে কাজ। কিন্তু কাজটা যে ভালো করে জানেন না নুরুল। সিদ্ধান্ত নিলেন, আগে কাজটাই শিখবেন।
ভাগ্য বদলাতে শুরু করল
২০০৬ সাল। কাঠের আসবাবে বিশেষ নকশার কাজটা ভালোই শিখলেন নুরুল। মাসে তখন ৮০-৯০ হাজার টাকার মতো আয় হয়। কোরিয়ান ভাষাটাও তত দিনে রপ্ত করেছেন। এরপর জই ফার্নিচার নামের আরেক জায়গা থেকে কাজের ডাক এল। বেতন বাংলাদেশি টাকায় লাখ খানেক। ২০০৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এভাবেই কাজ করে যেতে লাগলেন। নানা জায়গা থেকে কাজের ডাক আসতে লাগল।
নুরুল হক বলেন, ‘একদিন ফাসকো নামের এক কারখানায় যোগ দিলাম। আস্তে আস্তে ধার শোধ হতে লাগল। বোনের বিয়ে দিলাম। বাড়িঘরের অবস্থা বদলাল। আমি নিজেও বিয়ে করলাম। তবে বিয়েটা হলো ফোনে ফোনে। বউ মুন্সিগঞ্জেই থাকে। আমি বউকে বললাম, লেখাপড়া শেষ করে অনার্স পাস করো। আমি দেশে চলে আসব।’
ফাসকোর মালিক একদিন জানালেন, তিনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। কারখানাটি আর চালাতে পারছেন না।
নুরুল হক বলে যান, ‘এই কারখানা বন্ধের পর আরেক জায়গায় কাজ নিলাম। কিন্তু সেখানে প্রচণ্ড কষ্ট। বেতন কম। মালিক খারাপ ব্যবহার করেন। ছেড়ে দিলাম। আবারও শুরু হলো দিনমজুরের কাজ।’
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর। দোতলা কারখানার ওপরে কাজ করছেন নুরুল হক। বাকিটা শুনুন তাঁর কাছ থেকে।
‘ওই দিনের কথা কোনো দিন ভুলব না। হঠাৎ সাদাপোশাকে তিনজন পুলিশ এল। তাদের দুজন ছাদে উঠে এল। “সন্ত্রাসী’’ বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার তখন হুঁশ নাই। কি করব? ধরা পড়লে জীবন শেষ। ভয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গা-ঝাড়া দিলাম। দিলাম দৌড়।’
নুরুল হক যেন জীবন থেকেই ছিটকে পড়লেন।
তাঁর ভাষায়, ‘ছাদ থেকে পড়ে গেলাম নিচে। দুই পায়ের গোড়ালি ভেঙে গেল। আমি আর উঠে দাঁড়াতে পারি না। সে কী যন্ত্রণা! আমার বন্ধুরা এল। পুলিশ এল। অ্যাম্বুলেন্স আনা হলো। নেওয়া হলো হাসপাতালে। একদিন পরই অপারেশন। আমি আর দাঁড়াতে পারি না। দিন যায়, সময় যায়। হুইলচেয়ারে করে চলতে হয়। এক বছর পর আবার অপারেশন। এরপর ক্রাচ দিয়ে একটু পায়ে ভর দিতে পারি। কিন্তু হাঁটতে গেলেই যত ক্লান্তি।’
এভাবেই চলতে লাগল নামইয়াংজু থেকে সিউল মেডিকেল সেন্টারে যাওয়া-আসা। ডাক্তার, হাসপাতাল, ওষুধ নিয়েই জীবন।
নুরুল হকের ভাষায়, ‘সেই যে পড়লাম আর উঠতে পারছি না।’
ভুল তথ্যে অভিযান, অনুতপ্ত পুলিশ
নুরুল হক বলেন, ‘আমি কোথাও কোনো অপরাধ করি নাই। সব সময় নামাজ পড়তাম। পাঞ্জাবি পরতাম। শত্রুতাবশত কোনো এক বাংলাদেশি পুলিশের কাছে তথ্য দিয়েছিল যে আমি সন্ত্রাসী। কোরিয়ার মানুষ মিথ্যা বলে না। তাই পুলিশ কোনো যাচাই-বাছাই না করেই বিশ্বাস করেছিল।’
তবে অভিযানের পরপরই অভিবাসন পুলিশ বুঝতে পারে, তাদের ভুল হয়ে গেছে। নুরুল হক জানান, ‘হাসপাতালে পুলিশের কয়েকজন বড় কর্মকর্তা আমাকে দেখতে আসেন। তাঁদের একজন বলেন, ‘তোমার যা ক্ষতি হয়ে গেছে, তা তো ফিরে আসবে না। তবে তুমি যত দিন চাও, কোরিয়ায় থাকতে পারবে। আমরা তোমাকে কখনো ফেরত পাঠাব না।’
নুরুল হক বলেন, ‘হাসপাতালে আমার চিকিৎসার জন্য ৭০-৮০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। পুরোটাই কোরিয়া দিচ্ছে। কিন্তু আমার নিজের ওষুধ, থাকা খাওয়াদাওয়াসহ নানা কাজে ২০-২৫ লাখ টাকা ঋণ হয়ে গেছে। এত কিছুর বিনিময়েও তো আমি সুস্থ হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। ভাই, যদি কেউ কোটি টাকাও দেয়, আর বলে তোমার পা নিয়া নেব, আপনি কি রাজি হবেন?’
তবু আশাবাদী
নুরুল হকের ঘটনাটি আমরা জানতে চেয়েছিলাম দক্ষিণ কোরিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) জাহিদুল ইসলাম ভুইয়ার কাছে।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নুরুল হকের ঘটনাটি দুঃখজনক। এ বিষয়ে দূতাবাসের কাছে কোনো সহযোগিতা চাইলে আমরা করব। আমরা এ বিষয়ে আরও খোঁজখবর নিচ্ছি।’
এই এক যুগে জীবনের অনেক রূপ দেখে ফেলেছেন নুরুল হক। তাঁর পঙ্গু হয়ে যাওয়ার খবরে পুরো পরিবার মুষড়ে পড়েছে। এত কষ্টের মধ্যেও স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে যাননি। নুরুল চান না পত্রিকায় তাঁর স্ত্রী বা পরিবারের কারও নাম আসুক।
নুরুল হক বলছিলেন, ‘আমি তো এক যুগেও দেশে ফিরতে পারিনি। যখন ভেবেছিলাম দেশে যাব, তখন তো দুর্ঘটনাই ঘটে গেল। আমার স্ত্রী আমাকে খুব সাহস দেয়। আমার অনেক কষ্ট। তবু আমি জীবন নিয়ে আশাবাদী। সত্যের জয় হবেই। নিশ্চয়ই একদিন সবকিছু ঠিক হবে।’
ডে বাই ডে তথ্যচিত্রের পোস্টারতথ্যছবির জীবন
নুরুল হকের জীবনের দুঃখগাথা আর জীবনসংগ্রাম নিয়ে শেখ আল-মামুন তৈরি করেছেন প্রামাণ্যচিত্র ডে বাই ডে। ছবিটির ব্যাপ্তি ২৫ মিনিট। মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হচ্ছে।
কোরিয়ান মাইগ্রেন্টস ট্রেড ইউনিয়নের সহসভাপতি ও নির্মাতা বাংলাদেশের শেখ আল-মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেউ একজন পুলিশকে তথ্য দিয়েছে যে শাহিন (নুরুল হক) সন্ত্রাসী। তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অভিযোগ আছে, আর পুলিশও কোনো ধরনের বিচার না করে, এমনকি দূতাবাসে গিয়ে কোনো খোঁজ না নিয়েই অভিযান চালায়। একটা ছেলে আজ পঙ্গু। শুধু শাহিন নয়, কোরিয়ায় কয়েক হাজার অবৈধ বাংলাদেশি আছে। তারাও পুলিশের আতঙ্কে থাকে। শাহিনের বিষয়টি নিয়ে মানবাধিকারকর্মীরা আন্দোলন করেছে। আমরা এ নিয়ে ক্ষতিপূরণ ও হয়রানির মামলাও করেছি।’ prothom-alo
0 comments:
Post a Comment