বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে মালয়েশিয়া। তবে আপাতত নির্মাণ, বনায়ন ও উৎপাদন খাতে এই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হবে। এর ফলে শিগগিরই আবার দেশটিতে কর্মী যাওয়া শুরু হবে বলে আশা করছে সরকার।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য কর্মীপ্রতি খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৭ হাজার টাকা।
জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ার শ্রমমন্ত্রী সে দেশে আমাদের হাইকমিশনারকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি জানিয়েছেন। হাইকমিশনার কয়েক দিন আগে আমাদের চিঠি দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, কনস্ট্রাকশন, প্লান্টেশন ও ম্যানুফ্যাকচারিং—এই তিন খাতে কর্মী নেবে দেশটি।’
কবে নাগাদ কর্মী যাওয়া শুরু হবে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘ঈদের পরই এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানাতে পারব। এখন আমরা দুই দেশে অনলাইন পদ্ধতি চূড়ান্ত করছি। এরপর স্বাস্থ্য পরীক্ষার পদ্ধতিসহ আরও কিছু প্রক্রিয়া আছে। তবে আমরা আশা করছি দ্রুতই কর্মী যাওয়া শুরু হবে।’
চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি জি টু জি প্লাস (সরকারি ও বেসরকারিভাবে) পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকার সমঝোতা স্মারকে সই করে। কিন্তু এর ১২ ঘণ্টার মধ্যেই মালয়েশিয়া জানায়, এই মুহূর্তে তারা আর কোনো কর্মী নেবে না। এতে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া ঝুলে যায়। এরপর এই শ্রমবাজার নিয়ে নানা ধরনের কথা শোনা যায়। একপর্যায়ে গত মাসে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, ‘মালয়েশিয়া নিয়ে আমরা অন্ধকারে আছি।’
তবে কোন প্রক্রিয়ায় কর্মী যাবে, কারা এই কাজ পাচ্ছেন—এমন অনেক বিষয় নিয়ে এখনো ধোঁয়াশায় আছেন জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসায়ীরা। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের একটি বড় অংশের অভিযোগ, এবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললেও সব ব্যবসায়ীর জন্য সমান সুযোগ থাকছে না। এর বদলে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানই মালয়েশিয়ার কাজ পাচ্ছে। এ জন্য একটি গোপন চুক্তিও হয়েছে। তাঁরা কর্মীদের পাসপোর্ট সংগ্রহও শুরু করেছেন।
অবশ্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কোনো সিন্ডিকেটকে উৎসাহিত করছি না। বাংলাদেশ থেকে ৭৪৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিয়েছি মালয়েশিয়াকে। তারা যাকে ইচ্ছে কাজ দেবে। তবে এই মুহূর্তে বাজার চালু হোক, সেটা আমরা চাইছি। এরপর এসব বিষয় দেখা যাবে।’
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর্মী নেওয়ার বিষয়ে গত ১৬ জুন মালয়েশিয়ার একজন প্রভাবশালী জনশক্তি রপ্তানিকারকের সঙ্গে বাংলাদেশের দুজন শীর্ষ জনশক্তি ব্যবসায়ীর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর দুই দিন পর মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ হামিদি দেশটির গণমাধ্যমকে বলেন, মালয়েশিয়া আর সরকারিভাবে কর্মী নেবে না। এর বদলে বেসরকারিভাবে কর্মী যাবে।
জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সভাপতি বেনজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালয়েশিয়া এখন বেসরকারিভাবে লোক নিতে চায়। আমরা আশা করছি শিগগিরই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে।’ গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানই কাজ পাচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সব ব্যবসায়ীর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে চাই।’
প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর কর্মী পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ জি টু জি (সরকারিভাবে) চুক্তি করে মালয়েশিয়ার সঙ্গে। কিন্তু এই চুক্তির আওতায় তিন বছরে মাত্র ১০ হাজার কর্মী দেশটিতে যায়। এরপর সাগরপথে মানব পাচার, গণকবরসহ নানা বিষয় নিয়ে বিশ্বে সমালোচনা শুরু হলে বেসরকারিভাবে কর্মী নেওয়ার প্রস্তাব দেয় মালয়েশিয়া। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর গত বছরের ২৪ জুন মালয়েশিয়ার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহিদ হামিদি বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দেন।
তবে এই ঘোষণার পর নতুন করে কর্মী আনার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে নিতে দুটি পক্ষ তৎপর হয়ে ওঠে। একটির নেতৃত্বে থাকেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মালয়েশীয় নাগরিক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমিন বিন আবদুল নূর। মালয়েশিয়ার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজমি খালিদ, শ্রম বিভাগের সাবেক পরিচালক টেংকু ওমরসহ আরও কয়েকজন প্রভাবশালী এই পক্ষে। এই পক্ষ সিনারফ্ল্যাক্স নামে অনলাইন পদ্ধতিতে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করে। আর বায়রার সাবেক সভাপতি আবুল বাসারের নেতৃত্বে বেশির ভাগ জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসায়ী মালয়েশীয় নাগরিক আবু হানিফকে তাঁদের বৈদেশিক প্রতিনিধি মনোনীত করেন। তবে শেষ পর্যন্ত আমিনের কোম্পানিই অনলাইনের কাজ পায়। ফলে তাঁরা যেভাবে চাইবেন সেভাবেই সবকিছু হবে বলে আশঙ্কা অধিকাংশ ব্যবসায়ীর।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এই মুহূর্তে সরকার চাইছে যত দ্রুত সম্ভব বাজারটি চালু হোক। সে ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া কাদের দিয়ে লোক নেবে সেটা নিয়ে সরকার চিন্তিত নয়। তবে কর্মীদের যেন বেশি খরচ না হয় এবং তারা যেন প্রতারিত না হয় সে ব্যাপারে সরকার সতর্ক থাকবে। এ জন্যই ৩৭ হাজার টাকা খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন কারাম এশিয়ার আঞ্চলিক সমন্বয়ক হারুন আল রশিদ মালয়েশিয়া থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর আগে যতবার মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়েছে, ততবারই দুই দেশের চক্র দুর্নীতিতে জড়িয়েছে। আমরাও চাই বাজার খুলুক। তবে সরকারের উচিত সতর্ক থাকা, যাতে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষিত হয়।’ prothom-alo
About Jessica Hornberger
This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
0 comments:
Post a Comment