৯১ বছর বয়সে মারা গেছেন সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাতা লি কুয়ান ইউ। কিন্তু জীবদ্দশায় সিঙ্গাপুর বা এই বিশ্বের জন্য এমন কিছু করে গেছেন যার কারনে বিশ্ব ইতিহাসে সোনার অক্ষরে আজীবন লেখা থাকবে তাঁর নাম। এখন যে জায়গায় সিঙ্গাপুর, সেখানে একসময় ছিলো জেলেদের বাস। ১২০ টি জেলে পরিবার বাস করতো এখানে। কিভাবে এমন একটি জায়গাকে সিঙ্গাপুরে রুপায়ন করেছিলেন লি কুয়ান? টাইম ম্যাগাজিনের সাবেক এশিয়া বিষয়ক সম্পাদক ডোনাল্ড মরিসন ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন।
লি কুয়ানের সাথে আমার প্রথম দ্বন্দ্বটা হয় ১৯৮৬ সালের দিকে। আমি টাইমে তার সরকারের বিরোধী দলকে হেনস্তা করার একটি খবর প্রকাশ করি। খবরটির প্রতিবাদ জানিয়ে লি কুয়ানের দপ্তর থেকে বিস্তর এক প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়। আমি এটার পুরোটা না ছাপিয়ে সারাংশটা ছাপাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি চাইছিলেন পুরো প্রতিবাদ লিপিটাই ছাপতে। আমি অস্বীকার করলাম। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে সিঙ্গাপুরে টাইমের ৯০ শতাংশ প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেন লি কুয়ান। টাইমের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরের লোকাল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ আনা হয়। ৯ মাস অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর অবশেষে পুনরায় প্রকাশনার অনুমতি দেয়া হয়। বছরের পর বছর সিঙ্গাপুরকে দেখার ফলে আমি জানি এ রাষ্ট্রের শুরু ও চলতি পথটা কি রকম। দেশটির সর্বত্র লি কুয়ানের প্রশংসা। দেশটিকে তিনি ঝাঁ চকচকে করে তৈরী করেছেন। এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো যেখানে দুর্নীতিতে জর্জরিত, সেখানে আক্ষরিক অর্থেই সিঙ্গাপুরে কোনো দুর্নীতির লেশমাত্র ছিলো না। ১৯৬৫ সালে প্রতিবেশি মালয়েশিয়া থেকে আলাদা হওয়ার পর থেকেই মূলত এ দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে একটু একটু করে নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করেন লি কুয়ান। ৯ আগস্ট ১৯৬৫, লি কুয়ান ইউ জনগণের পক্ষ থেকে রিপাবলিক অব সিঙ্গাপুরের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার সময়েই ঘোষণা করা হয় সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের মূল নীতি হবে— স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, জনকল্যাণ, সমৃদ্ধি ও সাম্য।’ ১৯৬৫ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উন্মেষের আগে ও পরে বেশি কিছু কঠিক সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। শুধু ১৯৬১ সালেই এ দেশে ১১৬টি ধর্মঘট সংঘটিত হয়েছে। ১৯৬০ থেকে ’৬৭ সালের মধ্যে নেতাদেরকে মোট ৩৮৯ ধরনের বিরোধ সামাল দিতে হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং জনপ্রশাসনের সংস্কারসহ নানামুখী ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে অবস্থার অমূল পবির্তন সাধিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালের পর থেকে এ দেশে আর কোনো ধর্মঘট হয়নি। স্বাধীনতার সময় এখানকার মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫১১ মার্কিন ডলার। এখন ২০১৩’র হিসাব অনুযায়ী মাথাপিছু আয় (পিপিপি) ৬১, ৫৬৭ মার্কিন ডলার। ২০১০ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৪.৫ শতাংশ। জীবনযাত্রার গুণগত মান বিবেচনায় এ দেশের অবস্থান এখন এশিয়ায় প্রথম এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ১১তম। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে বিশ্বে এ দেশের অবস্থান যথাক্রমে ১৫ এবং ১৪তম স্থানে। একই সময়কালে এদের ভাণ্ডারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যা ছিল, তা বিশ্বের নবম সর্বোচ্চ রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। অন্যদিকে এ দেশের বৈদেশিক ঋণের অঙ্ক শূন্য।
পরিকল্পিত উন্নয়নের জোয়ারে জীবনযাপনে এসেছে অভাবিত পরিবর্তন, সে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে মনোজগত। দেশটিতে শিক্ষিতের হার ৯৬ শতাংশ, মানুষের গড় আয়ু ৮০.৬ বছর, আবাসন সুবিধাপ্রাপ্ত নাগরিক ৯০.১ শতাংশ এবং প্রতি ১০০০ জনে ১০৭ জন ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক। আদিতে মাছ ধরা ছিল একমাত্র পেশা। অভিবাসীদের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল শ্রমঘন সেক্টরে। কৃষিকাজ তেমন একটা হতো না; এখন তো একেবারেই নেই। এক কেজি চাল, এক লিটার দুধ কিংবা একটি ফল কোথাও উত্পাদন করা হয় না। শুধু সীমিত পরিসরে মাছ-মুরগি উত্পাদন করা হয়। পুরো নগররাষ্ট্রটি কঠোর নিয়ম-নীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। আইনের প্রশ্নে এখানে কারো জন্য কোনো ছাড় নেই। সবার জন্য আইন সমভাবে প্রযোজ্য। এ একবিংশ শতাব্দীতেও এ রাষ্ট্রে বেত্রাঘাতসহ মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠিন শাস্তি বহাল আছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে ১৯৯১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত এ দেশে মোট ৪০৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যা জনসংখ্যার অনুপাতে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে অ্যামনেস্টি কর্তৃক সমালোচিত। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ কথা সর্বজনবিদিত যে, এ দেশে কোনো করপোরেট ক্রাইম নেই, কোনো গ্যাংস্টার নেই, চাঁদাবাজ নেই, মাফিয়া চক্র নেই, মাদক সম্রাট নেই। উপরন্ত মানুষ এবং সম্পদ রাষ্ট্র কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত। পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা শতভাগ নিষ্কলুষ এবং গণমুখী। ২০০৮ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুরের বিচার ব্যবস্থা এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোত্তম। শূন্যকে সর্বোত্তম হিসাবের ভিত্তি ধরে চলমান বিচার ব্যবস্থা মূল্যায়নকালে দেখা গেছে, এক্ষেত্রে দশের মধ্যে হংকং-এর অর্জন ১.৪৫, সিঙ্গাপুরের ১.৯২, জাপানের ৩.৫০, সাউথ কোরিয়ার ৪.৬২ এবং তাইওয়ানের স্কোর ৪.৯৩।
নিষ্কলুষ রাজনৈতিক শিষ্ঠাচারসহ এ শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজের অর্জন রীতিমতো ঈর্ষণীয়। প্রায় আট হাজারের অধিক বহুজাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অফিস, কোম্পানি, কারখানা এ দেশের অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত। এখানকার প্রতিষ্ঠিত ফিন্যান্সিয়াল সেন্টার আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। সিঙ্গাপুরের কারেন্সি সিঙ্গাপুরি ডলার। আমাদের থেকে তাদের অর্থবছরও আলাদা। আমাদের অর্থবছর ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন। ওদের অর্থবছর ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ। ২০০৯ সালে দেশটির মোট জিডিপি পরিমাণ ছিল ২৩৫.৭ বিলিয়ন ডলার। খাতভিত্তিক বিভাজন করে দেখা যায়, ওই অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ২৬.৮ এবং সেবা খাতের অবদান ছিল ৭৩.২ শতাংশ। দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হারও অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে নির্ধারিত। ২০০৯ অর্থবছরে এ হার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। মুদ্রা ব্যবস্থার এই স্থিতিশীলতার কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও লাগামহীনভাবে ছুটতে পারে না। ফলে আর্থিক সেক্টরে কোনো ধরনের অস্থিরতা বা অনাহূত কম্পন নেই বললেই চলে। পাবলিক সার্ভিসের প্রায় পুরোটাই এখন প্রযুক্তিনির্ভর। কোনো কাজের জন্য কারো দুয়ারে ধরনা দিতে হয় না। ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সেবা গ্রহণ করা যায়। সমগ্র জনপ্রশাসনের বিভিন্ন অফিসে বহুবিধ বিষয়ে ই-মেইলে প্রতি ঘণ্টায় ৩৩ ৩৩৩টি হিট হয়। যার প্রেক্ষিতে প্রতি মিনিটে আটটি করে সার্ভিস প্রদান করা হয়। শতকরা ৮৫ ভাগ নাগরিক ইলেকট্রনিক সেবা সার্ভিসে সন্তুষ্ট। শুধু সার্ভিস প্রদান করেই কর্তারা বসে থাকে না, তারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পথের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকেন। এর সঙ্গে করা হয় মনোজগতের প্রয়োজনীয় সংস্কার। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য এখন সবক্ষেত্রে কাজের গুণগত উত্কর্ষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধির নিমিত্ত; ট্রাস্ট, নলেজ এবং কানেক্টিভিটির ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।
পর্যটনের ক্ষেত্রেও দেশটি অভাবিত সাফল্য অর্জন করেছে। বর্তমানে ১৭৫টি স্বাধীন দেশের সঙ্গে এ দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করছে। ২০০৭ সালে এ দেশে ১ কোটি ২ লাখ পর্যটকের সমাগম হয়েছিল। শুধু চিকিত্সা সেবা গ্রহণের জন্যই ওই সময়কালে দুই লাখ বিদেশী রোগী ওই দেশে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের নৈতিকতার দিকটি বিবেচনা করে স্বাধীনতার পর থেকে দেশে জুয়া খেলা অবৈধ ছিল, কিন্তু এখন পর্যটন শিল্পকে আরো বেশি সংহতকরণের স্বার্থে, টোকিও, হংকং ও সাংহাইয়ের মতো শহরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার জন্য এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির নিমিত্ত দেশে ‘ক্যাসিনো’ বৈধ করা হয়েছে। দীর্ঘ ৩১ বছর ক্ষমতায় থাকার পর যখন স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, ততদিনে সিঙ্গাপুর বিশ্বের অন্যতম সুন্দর ও উন্নত দেশ। দেশটির প্রবৃদ্ধি বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়েও বেশি। দেশটির যেকোনো বড় বড় স্থাপনার সাথে জড়িয়ে আছে লি কুয়ানের নাম। deshebideshe
0 comments:
Post a Comment