আশপাশে প্রতিদিনই শুনছি সিঙ্গাপুর থেকে কাউকে না কাউকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। দেশে ফিরতে হচ্ছে কোনোরকম পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই। তাদের গল্পগুলো এমনই।
সদ্য প্রবাসের খাতায় নাম লিখিয়েছে মাসুম। এসেই পড়েছে মন্দার কবলে। ওভারটাইম নাই। শুনতে পাচ্ছে অনেক লোক ছাঁটাই হবে। নিজের বিদেশে থাকা না থাকা নিয়ে প্রতিনিয়তই উদ্বিগ্ন।
ধারদেনা করে এজেন্ট ফি দিয়ে সুমন এক বছরের কাছাকাছি হলো এসেছিল এক সাপ্লাই কোম্পানিতে। এখনো ঋণের বোঝা বইছে। এদিকে কোম্পানি সাফ জানিয়ে দিয়েছে দেশে ফিরতে হবে বছর পেরোলেই। কোম্পানির নতুন কোনো কাজ নেই। এ অবস্থায় নতুনদের চাকরির চুক্তি নবায়ন সম্ভব নয়। সুমন ভাবছে কিন্তু কিছুতেই কুল কিনারা পাচ্ছে না।
রাতুল প্রবাসে আছে ছয় বছর। বিয়ে করে আবার প্রবাসী হয়েছে তিন মাস হয়। তেলের দাম নিম্নমুখী তাই বিদেশি শ্রমিক কমিয়ে দিচ্ছে কোম্পানি। রাতুলকেও ফিরতে হবে। বিয়ে উপলক্ষে মোটামুটি ভালো টাকাই খরচ করেছে। এখন দেশে গিয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বউকে লোকজন অপবাদ দেবে বা তাকেও হয়তো বলবে বউ পাগল তাই চলে এসেছে দেশে।
অর্ণব বিদেশে প্রতিষ্ঠার আশায় কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল ভালো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শেষ সেমিস্টারে পড়ছে। বিদেশে যা আয় করেছে তার বেশির ভাগই ব্যয় করেছে পড়াশোনার পেছনে। বাড়িটিও ঠিকমতো মেরামত করেনি। এতে দেশে থাকা বন্ধুরা নানা ধরনের কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেনি। ভেবেছিল পড়াশোনা শেষে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার সমুচিত জবাব দেবে। কিন্তু হায় তাকেও ফিরতে হবে। খবরটা শুনে তার মাথা ঘুরছে, শরীর বেয়ে টপটপে ঘাম ঝরছে।
রিয়াজ প্রবাসে এক যুগ পার করছে। ঢাকাতে বাড়ির জন্য প্রতি মাসে কিস্তি দিচ্ছে। আর এক বছর কিস্তি দিলেই সে ফ্ল্যাটের মালিক। দেশে ফেরতের খাতায় আছে তার নামও। এখন উপায়?
সমীর-প্রবাসে বিশ বছর পার করল। বোনদের বিয়ে দিয়ে বাড়ি ঘর করতে করতে একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করে। সঞ্চয় বলতে তেমন কিছু নেই। ছেলেমেয়েরা এখনো ছোট। পঁচিশ বছর প্রবাসে কাটিয়ে দেশে ব্যবসা করতে নাম লেখায় শেষ সম্বলটুকু দিয়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ব্যবসায় প্রতারণার শিকার হয়ে পথে বসে। এত দিনে দেশের কিছু মানুষের নৈতিকতা বা মূল্যবোধ যে অনেক নিচে নেমে গেছে তা বুঝে উঠতে পারেনি।
রহমান বিদেশে ভালোই আয় করত। তাতে সংসার খরচও বেড়ে যায়, আত্মীয়স্বজনকেও অনেক সহায়তা করেছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা তার ব্যবসাকেও আঘাত করে। এখন দেউলিয়ার পথে। ব্যাংক লোন কীভাবে পরিশোধ করবে সেই চিন্তায় ঠিকমতো খেতে ও ঘুমাতে পারছে না রহমান। অগত্যা পরিজনকে দেশে পাঠিয়ে নিজেও বাংলাদেশে থিতু হওয়ার পরিকল্পনায়। কিন্তু কীভাবে? পরিবার কি পারবে মানিয়ে নিতে?
এ রকম অসংখ্য প্রবাসী প্রতিনিয়ত দেশে ফিরছেন। সংখ্যাটা বহুগুণে বেড়েছে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির মন্থরগতির কারণে। বিগত বছরগুলোতে সিঙ্গাপুর ছিল রেমিট্যান্সের বড় একটা খাত। এভাবে মন্দাবস্থা আরও বছরখানেক প্রলম্বিত হলে হাজার হাজার প্রবাসীকে দেশে ফিরতে হবে। বিশেষত জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত শিল্পে কর্মরত প্রবাসীকে দেশে ফিরতে হচ্ছে গণহারে। ইমারত নির্মাণশিল্পের সংখ্যাটা নেহাতই কম নয়।
দুঃখের বিষয় এখনো পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ বা শ্রম মন্ত্রণালয়ের ঘুম ভাঙেনি। এসব প্রবাসীর পুনর্বাসন তো বহুদূর, প্রবাসীর বহর যে দেশের পথে তার তথ্য মন্ত্রণালয়ে আছে বলে সন্দিহান। এই হাজার হাজার প্রবাসীদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখ পরিবার। তাই প্রবাসীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করলে একদিকে যেমন পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে অন্যদিকে বেড়ে যাবে অন্যান্য জটিলতা, অপরাধপ্রবণতা। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে উল্লেখ্যযোগ্য হারে। এটা খুবই ভালো খবর। প্রবাসীদের সঠিকভাবে পুনর্বাসিত করা গেলে দেশের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে বহুগুণ। কারণ এদের আছে বিশেষ কর্মদক্ষতা, অভিজ্ঞতা। তাই সময় থাকতে পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরি।
অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও রেমিট্যান্সের কারিগর বিদেশফেরত প্রবাসীদের পুনর্বাসন নিয়ে দেশে কাজ করা এখন সময়ের দাবি।
0 comments:
Post a Comment