বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের কর্মী নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে সৌদি আরব। দীর্ঘ সাত বছর পর গত বুধবার সৌদি আরবের শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের জন্য বহু প্রত্যাশিত এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এই সাত বছর বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীরাই কেবল এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে ছিল। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল বৃহস্পতিবার এ খবর নিশ্চিত করেছে।
সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে সৌদি আরবের চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষি, নির্মাণসহ অন্যান্য খাতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকছে না। দক্ষ ও অদক্ষ—সব ধরনের বাংলাদেশি কর্মীরা সৌদি আরবে কাজের জন্য ভিসার আবেদন করতে পারবে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের খবরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। একইভাবে বিদেশে কর্মসংস্থানের অপেক্ষায় থাকা কর্মীদের জন্যও সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। সৌদি আরবের বিভিন্ন খাতেও গতি ফেরার আশা করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, সৌদি আরবের শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত হওয়া এ দেশের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফল। গত জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা ছিল এটি। পবিত্র দুই মসজিদের হেফাজতকারী সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সউদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফলপ্রসূ বৈঠক এ সিদ্ধান্তের পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। শ্রমবাজার উন্মুক্ত করায় বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে সৌদি বাদশাহকে তাঁর উদারতা ও অব্যাহত সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বলেন, ‘সৌদি আরব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করায় জনশক্তি রপ্তানি খাতে গতি ফিরে আসবে। নারী কর্মীদের নিয়োগ অব্যাহত রয়েছে। এখন সব ধরনের কাজে পুরুষরাও যেতে পারবে। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি ভালো খবর। প্রধানমন্ত্রীর সৌদি সফরের পরই এ সুখবরটি এসেছে। আশা করছি, অন্যান্য শ্রমবাজারও চালু হবে।’
এদিকে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য সৌদি আরবের শ্রমবাজারে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে জনশক্তি খাতের জন্য একটি বড় খবর বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সহসভাপতি মো. আবদুল হাই। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সৌদি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি কর্মীদের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে। তাই বাংলাদেশিদের ওই দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। এটা অনেক বড় সুখবর। তবে বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। কারণ পুরো প্রক্রিয়া শুরু হতে সময় লাগবে।’
আবদুল হাই বলেন, ‘সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে প্রতিনিয়ত আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সৌদি আরবে আবারও প্রচুর বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণ করা সম্ভব হবে।’
যেভাবে শুরু, যেভাবে নিষেধাজ্ঞা : জানা যায়, ১৯৭৬ সালের ১৭ এপ্রিল ২১৭ জন শ্রমিক নিয়ে সৌদি আরবে আনুষ্ঠানিকভাবে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়। এসব শ্রমিকের সঙ্গে ৬৪ টন বাংলার কাদামাটি এবং ৫০ কেজি নিমের বীজও পাঠানো হয়েছিল। সৌদি বিমান হিজবুল বাহারে করে পাঠানো এসব শ্রমিক দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের যাত্রা শুরু হয়। ২০০৮ সালে এসে নতুন নিয়মের বেড়াজালে পড়ে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ এক প্রকার স্থগিত হয়ে যায়। ২০০৯ সাল থেকে দেশটির যেকোনো খাতে সর্বোচ্চ ২০ ভাগ বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়।
এতে ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের হার ৯ ভাগের ১ ভাগে নেমে আসে। সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে এ বছরের ১০ আগস্ট পর্যন্ত দুই কোটি ৭৫ হাজার ৯৯৮ জন বাংলাদেশি কর্মী সৌদি আরব গেছে। এর মধ্যে ২০০৮ সাল থেকে গেছে এক লাখ ৯০ হাজার ৮৭৮ জন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বর্তমানে সৌদি আরবে প্রায় ১৩ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ হাজারেরও বেশি নারী গৃহকর্মী। উপেক্ষিত ছিল বাংলাদেশ : জানা গেছে, গত ৯ বছরে নতুন করে কোনো বাংলাদেশি চিকিৎসক ও সেবিকা (নার্স) নিয়োগ দেওয়া হয়নি সৌদি আরবে। গত ২৮ অক্টোবর সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রথম পর্যায়ে জরুরি বিভাগ, ট্রমা সেন্টার ও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের জন্য চিকিৎসক নিয়োগের লক্ষ্যে ৪৮টি টিম গঠন করে। এ টিমগুলো নিয়োগের জন্য ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, মিসর, জর্দান, তিউনিসিয়া, নাইজেরিয়া, লেবানন ও সুদানকে তালিকায় রাখে। ওই তালিকায়ও বাংলাদেশের নাম ছিল না।
এদিকে ২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর সৌদি সরকার তাদের নাগরিকদের উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে জরুরিভাবে ১০ হাজার ডাক্তার ও ২০ হাজার নার্স নিয়োগ এবং দুই হাজার ৯৫৮টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেয়। ফলে সৌদিতে বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক ও নার্সের প্রয়োজন দেখা দেয়। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তানসহ ৯টি দেশ থেকে চিকিৎসক নিয়োগ করে সৌদি সরকার। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সুনাম থাকায় সৌদির আগ্রহ বাড়ে। এ ছাড়া প্রতি সাত হাজার নাগরিকের জন্য একজন করে ডাক্তার ও তিনজন করে নার্স নিয়োগ করছে সৌদি আরব। চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশি চিকিৎসক সবচেয়ে বেশি সহায়ক হবে বলে মনে করছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
এ উপলক্ষে গত ১২ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ও সৌদি আরবের পক্ষে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রিক্রুটমেন্ট ডিপার্টমেন্টের জেনারেল ম্যানেজার মারজান বিন মুবারক আল-মারজান অংশ নেন। আলোচনায় মারজান বিন মুবারক আল-মারজান সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশি নার্স, ডাক্তার ও অন্য কর্মীদের কাজের প্রশংসা করে নিয়োগের আগ্রহ দেখান।
পরিপক্ব সম্পর্কের প্রতিশ্রুত প্রাপ্তি : সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পরিপক্ব ও নতুন মাত্রায় উন্নীত হওয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে গত ডিসেম্বর মাস থেকেই। রিয়াদের অনুরোধে সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী কেন্দ্রে (সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোট) বাংলাদেশ যোগ দিতে সম্মতি জানায়। নিরসন হয় বাংলাদেশিদের ওমরাহ ভিসা নিয়ে জটিলতা। ইরানে সৌদি দূতাবাস ও কনস্যুলেটে হামলার তীব্র নিন্দা জানায় বাংলাদেশ। এরই মধ্যে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সৌদি আরব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানাবে। এরপর গত মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় আসেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল বিন আহমেদ আল জুবেইর।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, আদেল বিন আহমেদ আল জুবেইরের আগে সৌদি আরবের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৮৩ সালে। সেই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ এখন অনেক পরিণত ও সারা বিশ্বে পরিচিত। বৈশ্বিক অনেক ইস্যুতে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দেয়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ উদার রাষ্ট্র হিসেবেও পশ্চিমা বিশ্বে এ দেশের বিশেষ মূল্যায়ন রয়েছে। বাংলাদেশে ৩৩ বছর পর সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে সৌদি আরবের কাছে এ দেশের গুরুত্ব, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের প্রতি সৌদি সরকারের আস্থার বহিঃপ্রকাশ, যা পরে আরো জোরালো হয়েছে গত জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি সফরের মধ্য দিয়ে।
মুসলমান দেশ হিসেবে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার প্রশ্নে সৌদি আরবের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মহলে জল্পনা-কল্পনা থাকলেও রিয়াদ আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো ঢাকার কাছে তা উত্থাপন করেনি। তা ছাড়া গত বছর অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম উইকিলিকসের ফাঁস করা সৌদি সরকারের নথি থেকে জানা যায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকাতে জামায়াত সৌদি সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় সৌদি সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার শুরুর দিকেই এ বিষয়ে নাক না গলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
উইকিলিকসের ফাঁস করা সৌদি সরকারের নথিগুলো থেকে আরো জানা যায়, বিএনপি চেয়ারপারসনের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে চিকিৎসার জন্য রাজকীয় খরচে থাইল্যান্ড থেকে সৌদি আরবে নিয়ে যেতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঠানো অনুরোধ সৌদি সরকার ফিরিয়ে দিয়েছিল। এ ছাড়া ২০১২ সালের দিকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মধ্যস্থতা করতে সৌদি সরকারের প্রতি বিএনপি-জামায়াতের অনুরোধেও রিয়াদ সাড়া দেয়নি। এসবের কারণ হলো ওই অনুরোধগুলো রাখলে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা ছিল। সৌদি সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চায়নি। জর্দান ও লেবানন থেকেও সুখবর :
জর্দান ও লেবাননে গৃহশ্রমিক এবং তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশি কর্মীদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে আরো দক্ষ কর্মী নিয়োগ করবে দেশ দুটি। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি এ সপ্তাহে জর্দান ও লেবানন সফরের সময় দেশ দুটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশ আশা করছে, শিগগিরই এ বাজার দুটি চালু হবে।
0 comments:
Post a Comment